অনুগল্প (থ্যালাসেমিয়া)

                                         থ্যালাসেমিয়া
                (অনিচ্ছাকৃত বানান ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থী)

আজ ৮ই মে , বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। কথাটা ভেবেই ঝরনার মুখে ম্লান হাসি খেলে গেল। হ্যাঁ!  ঝরনা একজন থ্যালাসেমিয়া পেইশেন্ট। দেড় বছর বয়সে তার এই রোগ ধরা পড়ে, আর তখন থেকেই তাকে রক্ত নিতে হয়। তার জীবনটাই
কেমন পরিহাস না ? যেখানে দেড়বছরের বাচ্চার রক্ত কি জিনিস বোঝার বয়সই হয়না; তখন থেকেই রক্ত আর সূঁচের সাথে তার গাঁটছড়া বাধা হয়ে যায়। কখনো কখনো পাঁচ-সাতবার সূঁচ ফুটিয়ে তার ছোট্টো ছোট্ট দুটো হাতপা ফুলে একসার হয়ে যেত, কখনো সূঁচ শিরায় ঠিকঠাক ফোটানো না হলে মাংশপেশীর মধ্যে রক্ত গিয়ে ফুলে কালশিটে পড়ে যেত আর তার সাথে  হতো প্রচন্ড যন্ত্রণা; আর হতোই বা বলছি কেন এখনোও তো  হয় । যখন সে আর একটু বড়ো হল, তার পাড়া- প্রতিবেশীরা তাকে জিজ্ঞেস করত, " হ্যাঁরে তুইযে রক্ত নিস, তোর লাগেনা, কষ্ট হয়না?" সে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলতো," না গো আমার একটুও লাগেনা ।" সে শুধু দেখতো তার চারপাশে আহা! উহুঁ!  করার লোকের অভাব নেই। আহারে এই মেয়েটার কি হবেরে! আত্মীয়স্বজন- পাড়া প্রতিবেশীদের এইসব বাড়ি বোয়ে এসে সিমপ্যাথি তার যেন অসহ্য লাগতো। সে অনেক ছোট বেলায় এটা বুঝে গিয়েছিল আর পাঁচটা বাচ্চার মতো তার জীবন সাভাবিক ভাবে কোনোদিন বইবেনা। শীতের ভোরে যখন সবাই লেপকম্বল মুড়ে ঘুমাতো, তখন তার মাবাবা তাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে হাসপাতালে রক্ত নিতে যাওয়ার জন্য রেডি করতো, সকালে যখন সব বাচ্চারা হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসতো তখন সে রাস্তায় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে চলেছে। আর মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতো," ঠাকুর আমার জীবনটাকে এমন সুন্দর করে দাওনা।" তার ঠাকুরমা বলতেন, "এসব পাপেরফল, না হলে কি আর এরকম অসুখ হয়?" শুধু ঠাকুরমাই বা কেন চারপাশের অনেকই এই কথাগুলো বলেছে তাকে।
সে এটাই বুঝতে পারতনা, মাত্র দেড়বছর বয়সে সে কি এমন পাপ করেছিল? তারপর যখন সে আরো একটু বড়ো হল; যখন  ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়তো, তখন থেকেই সে এটা বুঝে গিয়েছিল তার শুধুমাত্র আর পাঁচটা ছাত্রছাত্রীর  মতো পরিক্ষার আগে পড়াশুনা করলেই চলবে না। পরিক্ষার মাঝে কোন একদিন রক্ত ও নিতে হবে; যাতে তার পরিক্ষাটা সে সুস্থ্যভাবে দিতে পারে। আর যখন তার সব ক্লাসমেটরা পরিক্ষার মাঝে কোন একদিন ছুটি পেয়ে খুব পড়াশুনা করতো, সেদিন তখন সে হাসপাতালে বেডে শুয়ে রক্ত নিত । এসবের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল, কিন্তু তার সব থেকে খারাপ লাগতো যখন তার ক্লাসমেটরা তাকে এড়িয়ে চলতো, তাকে করুনার চোখে দেখতো। সেও আসতে আসতে নিজেকে তাদের থেকে গুটিয়ে নিল। নিজের পড়া আর গল্পের বই  এই ছিল তার দুনিয়া। এই রকম ভাবে হাজার সমস্যার মাঝে তার স্কুল জীবন শেষ হল। কলেজ জীবন শুরু হলো। নতুন জীবনে নতুন মানুষও এল সারাজীবন পাসে থাকার অঙ্গীকার নিয়ে , ভালবাসার রঙে জীবন রঙিন হল। কলেজ শেষে সে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে কাজকরতে শুরু করেছে।তার দুচোখে তখন নতুন জীবন শুরু করার স্বপ্নেরা ডানা মেলে উড়ছে। কিন্তু তার সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হতেও বেশি দিন লাগেনি। সে একদিন জানতে পারল তার স্বপ্নের মানুষটি দুবছর ধরে একটি মেয়ের সাথে রিলেশনে ছিল; তারপর তাকে বিয়ে করেছে। সে বুঝতে পারলো, আজ দুবছর ধরে সে প্রতারিত। যখন সে সেই মানুষটির মুখোমুখি হল, তখন সেই মানুষটি কি সুন্দর বুঝিয়ে দিল, তার সঙ্গে সংসার করা যায়না , তার যে বড়ো অসুখ। তাকে ব্যবহার করা যায়, তার সঙ্গে টাইমপাস করা যায়, এমনকি এক্সট্রাম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্সও করা যায়। কিন্তু তার সাথে জীবন অতিবাহিত? অসম্ভব!
এরপর সে বাবামায়ের ইচ্ছেতে চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে যায়। শুরু করে ছোট ছোট বাচ্চাদের পড়নো। তার বাবামা ও আত্মীয়স্বজনরা , পারিপার্শ্বিক লোকলোকজন ততদিনে তাকে ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছে সে সংসারের
হিসাবের বাইরে পড়ে। ছোট ছোট ভাইবোনদের বিয়ের অনুষ্ঠানে যখন সে যেত, সবায়ের অলক্ষ্যে দুফোঁটা চোখের জল সযত্নে মুছে নিত। তারপরেও তো  আত্মীয়স্বজনদের আবার হাজারটা সিমপ্যাথি তার উপর বর্ষিত হতো। এরপরতো ছিল তার রং নিয়ে হাজারটা কথা, তার পরিবারে সবাই ফর্সা; শুধুমাত্র তার রং কেন অমাবস্যার মতো। সে কাকে বোঝাবে তার ছোট বেলার কাঁচা সোনার রং আজ রক্তের আয়রন মিশে কয়লায় পরিনত হয়েছে ।অনুষ্ঠানের দিনগুলোতে সে তার ভাইবোন ,বাবামা আত্মীয়স্বজন সবায়ের মাঝেই থাকতো; অথচ কোথাও ছিলোনা সে।
এভাবেই সাতচল্লিশটা বছর সে কাটিয়ে দিয়েছে। আজ আর বাবামা বেঁচে নেই। ভাই নিজের সংসারগুছিয়ে নিয়েছে অন্য এক জায়গায়। বাবামা যতই তাকে খরচের খাতায় ফেলে দিকনা কেন, যতই মুখে বলুক না কেন, "আমাদের যাকিছু আছে সেতো আমার ছেলেরই।" তবুও তাকে পথে বসিয়ে যায়নি। তার জন্যে সামান্য যে টুকু ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স রেখেগেছিল ; তাই দিয়েই এক কামরার একটা ফ্ল্যাট কিনে বাস করছিল সে। মাসে একবার করে রক্ত নিয়ে, কিছু বাচ্চাদের পড়িয়ে দিব্যি তার একার সংসার ভালোই চলছিল।

 কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো এই লগডাউনের দিনগুলো। মানুষ সব ঘরে বন্দী। তাই কোথাও রক্তদান হচ্ছে না। আর সেইজন্যে তাদের মতো হাজার হাজার পেইশেন্টরা রক্ত না পেয়ে ঘরে বসে বসে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হয়তো এভাবেই তাদের কারো কারো জীবনের সমাপ্তি হবে। হয়তো আজ নাহয় কাল করোনার ওষুধ বেরিয়ে যাবে, ক্যান্সারের মতো মারনরোগের ও ওষুধ বেরিয়ে গেছে ! কখনো কি তাদের রোগের ওষুধ বেরোবে না?  কখনো কি একফোঁটা রক্তের বিকল্প কি কোনো ওষুধ তৈরী হবে না তাদের মতো মানুষদের জন্য?  কখনো কি মানুষ আর একটু সচেতন হবে না যাতে আর একটা বাচ্চা থ্যালাসেমিয়া না নিয়ে জন্মায়? 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

রঘু ডাকাত ও তার ডাকাত কালীর মন্দিরের ইতিহাস

Kolkata's Some Memorable Horror Place ( কলকাতার কিছু বিখ্যাত ভূতুড়ে স্থান )

ভূতচতুর্দশী