আশার আলো
আশার আলো
(এই গল্পটি আমার লেখা প্রথম গল্প আর এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল চালচিত্র পত্রিকায়( e-book) ....আজ আবার গল্পটিকে আমার বন্ধুদের জন্য দিলাম এই পেজে...... আর আমার এই ছোট গল্পটিতে যদি কোন বানান ভুল হয়ে থাকে তো আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমা প্রার্থী)
মিলি আজ এক নতুন জীবনের আশায় দেরাদুনের পথে চলেছে । দুদিন পর থেকেই তার নতুন চাকরি তে জয়েন করার কথা । ট্রেনে যেতে যেতে কত কথা মনে পড়তে লাগলো । মনে পড়তে লাগলো তার স্কুল-কলেজ জীবনের কতকথা । তার বাবা-মায়ের কথা । বাবা- মা কখনোই তার এই বাইরে চাকরি করাটাকে মন থেকে মেনেনিতে পারেননি ।
মিলি ছোটবেলা থেকেই গ্রামে বড়ো হলেও ; তার মা তাকে শহরের আদব-কায়দায় তৈরী করেছিলেন । তারপর যখন সে কলকাতার কলেজে ভর্তি হল ইনজিনিয়ারিং পড়তে; তখন থেকেই সে কলকাতাকে যেন আরও বেশি করে ভাল বাসতে শুরু করেছিল । এর অবশ্য আরও একটা কারণ ছিল, যেটা সে সবায়ের অলক্ষ্যে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল ।আর সেটা হল তার ভালবাসার মানুষটির কথা। তার কলেজ আর রাজের কলেজ ছিল পাশাপাশি। যখন তারা কলেজের ক্লাস শেষে দলবেঁধে হস্টেলে ফেরার বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো, তখন পাশের কলেজের ছেলেদেরও একটা দল বাসের অপেক্ষায় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতো । তাদের মধ্যে একটা শ্যামবর্ণ, বেশ লম্বা ছেলে প্রায়ই ওকে দেখত কিন্তু কথা হতোনা । হঠাৎ একদিন প্রাকটিক্যাল পরিক্ষা থাকায় মিলির কলেজ থেকে বেরোতে দেরি হয়ে গেছিল, সে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখল সেখানে বেশ ফাঁকা । আজ লোকজন বেশ কম। একে শীতকাল , তাই সন্ধ্যেটাও তাড়াতাড়ি নেমে গেছে । তার ওপর আজ আবার তার বন্ধু অনুও নেই, টিউশন আছে বলে আগে চলেগেছে। বেশ একটু ভয়ই করতে লাগল তার। বাস আসার এখন দেরি দেখে বসল যাত্রীপ্রতিক্ষালয়ে। এমন সময়, পাসে থেকে একটা ছেলের কন্ঠস্বরে, চমকে তাকালো ।
আরে ভয় পেয়না! আমি তোমাদের পাসের কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমার নাম রাজ বোস।
নানা ভয় কেন পাব?
তাহলে এমন চমকে উঠলে কেন?
আসলে আমি অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারিনি ।
ও আচ্ছা! বুঝলাম ।
তারপর থেকে দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল । আর আস্তে আস্তে কবেথেকে বন্ধুত্বটা যে ভালবাসার পরিনত হল, সেটা সে বুঝতেই পারলোনা। তার কাছে দিনগুলো কেমন স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগলো । দেখতে দেখতে কলেজ জীবনও শেষ হল। কলেজ শেষে রাজ ভাল চাকরিও পেয়ে গেল। কিন্তু কলেজে ক্যাম্পাসিং ভাল না হওয়ায় মিলি চাকরি পেলনা । তার তো খুব চিন্তা হতে লাগলো, সে কলকাতাতে চাকরি না পেলে থাকবে কি করে? আর রাজের সাথে দেখাই বা হবে কি করে ?
রাজ বলল, অত চিন্তার কি আছে ? অইটি সেক্টরগুলোতে মেল করো, কোথাও না কোথাও ঠিক চাকরি পেয়ে যাবে ।
রাজের কথামতো সে চেষ্টা করে দু-এক মাসের মধ্যেই চাকরি পেয়ে গেল এক আইটি সেক্টরে । এরপর তাদের চাকরি জীবন বেশ ভালোই কাটছিল । প্রায়ই তারা অফিসের শেষে পার্কে ঘুরতে যেত। মিলির রান্নার হাত বেশ ভালোই ছিল তাই মাঝে মাঝেই ভালোকিছু রান্না করে রাজ কে খাওয়াতে চেষ্টা করতো। অবশ্য এতে সে রাজের কাছ থেকে বেশ প্রসংশাই পেত। এই ভাবে দিনগুলো ভালোই কাটছিল । সে রাজ কে নিয়ে এক নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখতে লাগলো । সে যখন দেখত, রাজ তার ছোট ছোট বিষয়ে খুব খেয়াল রাখে, তারপর তো আবার দিনে তিন চার বার তাকে ফোন করবেই, রোজ রাতে ঘুমানোর আগে তার সাথে সারাদিনের গল্প না করলে ওর নাকি ঘুমই হয়না । এসব কারণে ও রাগ দেখালেও, মনে মনে খুশীই হয়ে বলত , পাগল ছেলে একটা ! সে তার ভালবাসার মানুষটির সাথে তখন এক সুখের সাগরে ভেসে চলেছে আর তার দুচোখে তখন আগামী দিনের রঙিন স্বপ্নরা ভিড় করতে লাগল । কিন্তু সবায়ের জীবনে কি সুখ সয় ? বোধ হয় না ! তাই তার জীবনেও সুখ সইলো না। হঠাৎ মিলির জীবনের ছন্দপতন হল। চাকরি পাওয়ার পর বেশ ভালোই কেটেছিল। তারপর থেকে সে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছিল । প্রায়ই অফিস কামাই হচ্ছিল। হঠাৎ একদিন প্রচন্ড জ্বরে সে অফিসে বসে কাজ করতে পারছিলনা, তাই দেখে অফিস থেকে তাকে কয়েক দিনের ছুটি দিল , ডাক্তাতদেখানোর জন্য । মিলির জ্বর রাতে আরও বাড়ল । সে যে মেয়েটির সাথে ঘর শেয়ার করে থাকতো , সেই মেয়েটি তার বেহুঁশ অবস্থা দেখে তার বাবা মা কে খবর দিল। তাঁরা খবর পেয়ে ছুটে এলেন । মিলিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ডাক্তারবাবু তাকে অনেক পরিক্ষা- নীরিক্ষা করানোর পর জানালেন ; তার কিডনির সমস্যা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করতে হবে । প্রায় এক মাস হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর সে বাড়িতে ফিরে গেল; বাবা মায়ের সাথে । ডাক্তারবাবু বললেন তাকে কিছুদিন বেড রেস্ট নিতে আর তিন মাস অন্তর রেগুলার রুটিন চেকআপ করাতে। এছাড়া যতদিন সে বাঁচবে সারাজীবন তাকে ওষুধ খেয়ে যেতে হবে । তবে সে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে পারবে। এখন অনেকদিন তাকে রেস্টে থাকতে হবে বলে, তাকে চাকরিটা বাধ্য হয়েই ছাড়তে হলো । এদিকে রাজ সে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে একবারও ফোন করেনি বা কোন খবরও নেয়নি । তবে কি রাজ তাকে ভুলে গেছে ? সে যখন হাসপাতালে ছিল, অপারেশনের দু-চারদিন পর যখন থেকে সে তার বন্ধু অনুর কাছে বারবার রাজের কথা জিজ্ঞেস করছে, তখন সে চুপকরে থেকেছে । মিলি বাড়িতে ফেরার পর, অনু তাকে ফোন করে খবর নিতে কিন্তু সে আবারও রাজের কথা জিজ্ঞেস করায়, অনু বলল তুই রাজ কে ভুলে যা , অমি রাজ কে তোর কথা সব বলেছি। কিন্তু সে আর আসবে না বলেছে ।
অনু ফোন রাখার পরও সে ঠিক বুঝতে পারলো না । সে রাজের সম্পর্কে কেন এই কথাগুলো বলল ? রাজ কি তবে তাকেএড়িয়ে চলতে চায় ? তার অসুখ হয়েছে বলে ? নাকি অনু তাকে মিথ্যে কথা বলছে ? যে রাজ তাকে চোখে হারাতো, তার সাথে কথা না বললে যার চোখে নাকি ঘুমই আসেনা, সে তাকে এভাবে ভুলে যেতে পারে? কথাগুলো সে নিজের মনকেই যেন বিশ্বাস করাতে পারছিল না । নানা এ হতেই পারেনা! নিশ্চয়ই তার কোথাও ভুল হচ্ছে। নিশ্চয়ই রাজ রাগ করেছে তার ওপর । তবে কি সে এক বার রাজ কে ফোন করবে? না থাক । মিলির মনে মনে খুব অভিমান হলো ।কেন রাজ তাকে কি একবারও ফোন করতে পারতনা, সে অসুস্থ জেনেও? এই তার ভালবাসা ? কিন্তু অবুঝ মন সত্যি টাযে মানতেই চায়না । হায়রে অবুঝ মন! দোনামোনা করতে করতে রাজ কে সে ফোনটা করেই ফেল্লো । একি রাজের কোন নম্বরে ফোন লাগছে না কেন? তার হর্সটআপ , ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখল সবজায়গায় সে তাকে ব্লক করে দিয়েছে। মিলির দু চোখ ফেটে জল এল। এরপর সারা রাত ঘুমাতে পারলোনা সে । সকালে তার কি মনে হতে বোনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে রাজের অ্যাকাউন্ট চেক করতে গিয়ে রাজের ভাইয়ের , রাজ কে ট্যাগ করা একটা ফটো দেখে তার পৃথিবী দুলে উঠলো ।আজ রাজের গায়ে হলুদের ফটো কিছুক্ষণ আগে পোস্ট করা হয়েছে। রাজ তার বোনেদের থেকে হলুদ মাখছে হাসি হাসি মুখে । তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কত খুশী ও। ও আর কিছু ভাবতে পারলোনা । লগ-আউট করে ফোনটা রেখেদিল । তার সমস্ত শরীরে কাঁপুনি দিয় জ্বর আসল, সমস্ত হুঁশ লোপ পেল জ্বরের চোটে । তারপর তাকে আবারও হাসপাতালে ভর্তি করাহল। দুদিন পর যখন মিলির হুঁশ ফিরল, তখন সে যেন এক অন্য মানুষ। এ মিলিকে যেন তার কাছের মানুষদের কাছে অচেনা লাগলো । আগের মতো সদা হাসি মুখে থাকা মেয়েটি যেন কোথায় হারিয়ে গেল । সে আবারও হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে এলো । এতো দিনে রাজের বিয়ে বউভাত মিটে গেছে । কিন্তু মিলির সভাব কেমন যেন পাল্টে গেল । সে কারোর সাথে ভালোকরে কথা বলেনা, সারাদিন চুপচাপ থাকে , একটার বেশি দুটো কথা বললে রেগে যায়, ঠিক মতো খায়না, চোখের তলায় দিনে দিনে কালি পড়তে লাগলো । তার বাড়ির লোকেরা ভাবলো অসুস্থ বলে সে এমনটা হয়ে গেছে । একমাত্র আসল ঘটনাটা কি সেটা জানতো অন, এরকম ভাবে মাস খানেক যাওয়ার পর তারকাছে একটা নতুন ছেলের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। ফেসবুকের ছেলেটা যেন তার সাথে যেচে যেচে কথা বলতে লাগলো। মিলির কেমন সন্দেহ হওয়ায় সে রাজের ফোন নাম্বার দিয়ে চেক করে দেখল অ্যাকাউন্টটা রাজেরই। এরপর মিলির আর মাথা ঠিক কাজ করছিল না। সে রাজ কে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো । সে কি চায়? কেন তাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে? রাজের উত্তর শুনে সে হতভম্ব হয়ে গেল।
রাজ বলল, দেখ মিলি তুমি আমাকে ব্লক কেন করেছ ? আমি তো দুদিনের জন্যে ব্লক করেছিলাম, যাতে আমার বিয়ের সময় কোন ঝামেলা না হয় । তাই বলে তুমিও আমাকে ব্লক করবে । আমি জানি, আমি তোমাকে তোমার অসুখের সময় দিতে পারেনি । তা বলে তুমি এভাবে রাগ করবে? মিলি আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বলল, আমার আর তোমার সাথে কোন সম্পর্ক নেই । তুমি একজন বিবাহিত পুরুষ অন্য মহিলা কে এভাবে ডিস্টার্ব না করাই তোমার পক্ষে ভাল হবে ।
রাজ বলল আমি বিয়ে করেছি তো কি হয়েছে? তা বলে কি তোমাকে ভালোবাসি না? দেখ বউ থাকবে বাড়িতে, আর তুমি থাকবে কলকাতাতে, আগে যেমন ছিলে আমার তেমনই থাকবে । আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি মিলি। এতোদিন মিলি ভেবেছিল ও যদি অন্য কাউকে নিয়ে সুখী হয় তো হক। কিন্তু আজ ওর কথা শুনে, ঘেন্নায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করলো তার । এতোদিন এইরকম একটা নোংরা, বিক্রিতমনষ্ক ছেলেকে সে ভালবেসেছিল? ভাবলেই তার ঘেন্না হচ্ছে নিজের প্রতি ।
এরপর কেটে গেছে একটা বছর । মিলি এখন অনেকটাই সুস্থ্য । সেদিনের পর থেকে সে আর কোন ভাবেই সেই নোংরা ছেলেটার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেনি । কিন্তু তার ভাঙা মন আর জোড়া লাগেনি । বরং তাকে আরও পাথরের মতো শক্ত করেছে। এই এক বছরে সে অনেক খেটেখুটে রেলের জুনিয়র ইনজিনিয়ারের চাকরি পেয়েছে । দুদিন পর তার জয়েনিং দেরাদুনে । তাইসে আজ দেরাদুনের পথে চলেছে এক নতুন জীবনের স্বপ্ন দুচোখে মেখে । ট্রেন ছুটে চলেছে দু্র্বার গতিতে । হঠাৎ এক ঝাকুনিতে মিলির ভাবনায় ছেদ পড়ে । না সে আর পিছনে ফিরে তাকাবে না । সে এগিয়ে যাবে নতুন জীবনের পথে। নিজেতো এগিয়ে যাবেই । আর যেসব মেয়েরা অসহায়, যাদের দেখার কেউ নেই, তাদেরকেও সাহায্য করবে সে। তার ইনকামের পয়সা দিয়ে একটা এনজিও খুলবে । সে নিজের কাছে নিজেই শপথ নিল। রাতের শেষে অন্ধকার কেটে গিয়ে, নতুন ভোরের সূর্যের আলো উঠলো এক নতুন দিনের আশার আলো নিয়ে ।
(এই গল্পটি আমার লেখা প্রথম গল্প আর এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল চালচিত্র পত্রিকায়( e-book) ....আজ আবার গল্পটিকে আমার বন্ধুদের জন্য দিলাম এই পেজে...... আর আমার এই ছোট গল্পটিতে যদি কোন বানান ভুল হয়ে থাকে তো আমি আন্তরিক ভাবে ক্ষমা প্রার্থী)
মিলি আজ এক নতুন জীবনের আশায় দেরাদুনের পথে চলেছে । দুদিন পর থেকেই তার নতুন চাকরি তে জয়েন করার কথা । ট্রেনে যেতে যেতে কত কথা মনে পড়তে লাগলো । মনে পড়তে লাগলো তার স্কুল-কলেজ জীবনের কতকথা । তার বাবা-মায়ের কথা । বাবা- মা কখনোই তার এই বাইরে চাকরি করাটাকে মন থেকে মেনেনিতে পারেননি ।
মিলি ছোটবেলা থেকেই গ্রামে বড়ো হলেও ; তার মা তাকে শহরের আদব-কায়দায় তৈরী করেছিলেন । তারপর যখন সে কলকাতার কলেজে ভর্তি হল ইনজিনিয়ারিং পড়তে; তখন থেকেই সে কলকাতাকে যেন আরও বেশি করে ভাল বাসতে শুরু করেছিল । এর অবশ্য আরও একটা কারণ ছিল, যেটা সে সবায়ের অলক্ষ্যে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিল ।আর সেটা হল তার ভালবাসার মানুষটির কথা। তার কলেজ আর রাজের কলেজ ছিল পাশাপাশি। যখন তারা কলেজের ক্লাস শেষে দলবেঁধে হস্টেলে ফেরার বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো, তখন পাশের কলেজের ছেলেদেরও একটা দল বাসের অপেক্ষায় সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতো । তাদের মধ্যে একটা শ্যামবর্ণ, বেশ লম্বা ছেলে প্রায়ই ওকে দেখত কিন্তু কথা হতোনা । হঠাৎ একদিন প্রাকটিক্যাল পরিক্ষা থাকায় মিলির কলেজ থেকে বেরোতে দেরি হয়ে গেছিল, সে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখল সেখানে বেশ ফাঁকা । আজ লোকজন বেশ কম। একে শীতকাল , তাই সন্ধ্যেটাও তাড়াতাড়ি নেমে গেছে । তার ওপর আজ আবার তার বন্ধু অনুও নেই, টিউশন আছে বলে আগে চলেগেছে। বেশ একটু ভয়ই করতে লাগল তার। বাস আসার এখন দেরি দেখে বসল যাত্রীপ্রতিক্ষালয়ে। এমন সময়, পাসে থেকে একটা ছেলের কন্ঠস্বরে, চমকে তাকালো ।
আরে ভয় পেয়না! আমি তোমাদের পাসের কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। আমার নাম রাজ বোস।
নানা ভয় কেন পাব?
তাহলে এমন চমকে উঠলে কেন?
আসলে আমি অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারিনি ।
ও আচ্ছা! বুঝলাম ।
তারপর থেকে দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল । আর আস্তে আস্তে কবেথেকে বন্ধুত্বটা যে ভালবাসার পরিনত হল, সেটা সে বুঝতেই পারলোনা। তার কাছে দিনগুলো কেমন স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগলো । দেখতে দেখতে কলেজ জীবনও শেষ হল। কলেজ শেষে রাজ ভাল চাকরিও পেয়ে গেল। কিন্তু কলেজে ক্যাম্পাসিং ভাল না হওয়ায় মিলি চাকরি পেলনা । তার তো খুব চিন্তা হতে লাগলো, সে কলকাতাতে চাকরি না পেলে থাকবে কি করে? আর রাজের সাথে দেখাই বা হবে কি করে ?
রাজ বলল, অত চিন্তার কি আছে ? অইটি সেক্টরগুলোতে মেল করো, কোথাও না কোথাও ঠিক চাকরি পেয়ে যাবে ।
রাজের কথামতো সে চেষ্টা করে দু-এক মাসের মধ্যেই চাকরি পেয়ে গেল এক আইটি সেক্টরে । এরপর তাদের চাকরি জীবন বেশ ভালোই কাটছিল । প্রায়ই তারা অফিসের শেষে পার্কে ঘুরতে যেত। মিলির রান্নার হাত বেশ ভালোই ছিল তাই মাঝে মাঝেই ভালোকিছু রান্না করে রাজ কে খাওয়াতে চেষ্টা করতো। অবশ্য এতে সে রাজের কাছ থেকে বেশ প্রসংশাই পেত। এই ভাবে দিনগুলো ভালোই কাটছিল । সে রাজ কে নিয়ে এক নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখতে লাগলো । সে যখন দেখত, রাজ তার ছোট ছোট বিষয়ে খুব খেয়াল রাখে, তারপর তো আবার দিনে তিন চার বার তাকে ফোন করবেই, রোজ রাতে ঘুমানোর আগে তার সাথে সারাদিনের গল্প না করলে ওর নাকি ঘুমই হয়না । এসব কারণে ও রাগ দেখালেও, মনে মনে খুশীই হয়ে বলত , পাগল ছেলে একটা ! সে তার ভালবাসার মানুষটির সাথে তখন এক সুখের সাগরে ভেসে চলেছে আর তার দুচোখে তখন আগামী দিনের রঙিন স্বপ্নরা ভিড় করতে লাগল । কিন্তু সবায়ের জীবনে কি সুখ সয় ? বোধ হয় না ! তাই তার জীবনেও সুখ সইলো না। হঠাৎ মিলির জীবনের ছন্দপতন হল। চাকরি পাওয়ার পর বেশ ভালোই কেটেছিল। তারপর থেকে সে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছিল । প্রায়ই অফিস কামাই হচ্ছিল। হঠাৎ একদিন প্রচন্ড জ্বরে সে অফিসে বসে কাজ করতে পারছিলনা, তাই দেখে অফিস থেকে তাকে কয়েক দিনের ছুটি দিল , ডাক্তাতদেখানোর জন্য । মিলির জ্বর রাতে আরও বাড়ল । সে যে মেয়েটির সাথে ঘর শেয়ার করে থাকতো , সেই মেয়েটি তার বেহুঁশ অবস্থা দেখে তার বাবা মা কে খবর দিল। তাঁরা খবর পেয়ে ছুটে এলেন । মিলিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। ডাক্তারবাবু তাকে অনেক পরিক্ষা- নীরিক্ষা করানোর পর জানালেন ; তার কিডনির সমস্যা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়ার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অপারেশন করতে হবে । প্রায় এক মাস হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর সে বাড়িতে ফিরে গেল; বাবা মায়ের সাথে । ডাক্তারবাবু বললেন তাকে কিছুদিন বেড রেস্ট নিতে আর তিন মাস অন্তর রেগুলার রুটিন চেকআপ করাতে। এছাড়া যতদিন সে বাঁচবে সারাজীবন তাকে ওষুধ খেয়ে যেতে হবে । তবে সে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে পারবে। এখন অনেকদিন তাকে রেস্টে থাকতে হবে বলে, তাকে চাকরিটা বাধ্য হয়েই ছাড়তে হলো । এদিকে রাজ সে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে একবারও ফোন করেনি বা কোন খবরও নেয়নি । তবে কি রাজ তাকে ভুলে গেছে ? সে যখন হাসপাতালে ছিল, অপারেশনের দু-চারদিন পর যখন থেকে সে তার বন্ধু অনুর কাছে বারবার রাজের কথা জিজ্ঞেস করছে, তখন সে চুপকরে থেকেছে । মিলি বাড়িতে ফেরার পর, অনু তাকে ফোন করে খবর নিতে কিন্তু সে আবারও রাজের কথা জিজ্ঞেস করায়, অনু বলল তুই রাজ কে ভুলে যা , অমি রাজ কে তোর কথা সব বলেছি। কিন্তু সে আর আসবে না বলেছে ।
অনু ফোন রাখার পরও সে ঠিক বুঝতে পারলো না । সে রাজের সম্পর্কে কেন এই কথাগুলো বলল ? রাজ কি তবে তাকেএড়িয়ে চলতে চায় ? তার অসুখ হয়েছে বলে ? নাকি অনু তাকে মিথ্যে কথা বলছে ? যে রাজ তাকে চোখে হারাতো, তার সাথে কথা না বললে যার চোখে নাকি ঘুমই আসেনা, সে তাকে এভাবে ভুলে যেতে পারে? কথাগুলো সে নিজের মনকেই যেন বিশ্বাস করাতে পারছিল না । নানা এ হতেই পারেনা! নিশ্চয়ই তার কোথাও ভুল হচ্ছে। নিশ্চয়ই রাজ রাগ করেছে তার ওপর । তবে কি সে এক বার রাজ কে ফোন করবে? না থাক । মিলির মনে মনে খুব অভিমান হলো ।কেন রাজ তাকে কি একবারও ফোন করতে পারতনা, সে অসুস্থ জেনেও? এই তার ভালবাসা ? কিন্তু অবুঝ মন সত্যি টাযে মানতেই চায়না । হায়রে অবুঝ মন! দোনামোনা করতে করতে রাজ কে সে ফোনটা করেই ফেল্লো । একি রাজের কোন নম্বরে ফোন লাগছে না কেন? তার হর্সটআপ , ফেসবুক অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখল সবজায়গায় সে তাকে ব্লক করে দিয়েছে। মিলির দু চোখ ফেটে জল এল। এরপর সারা রাত ঘুমাতে পারলোনা সে । সকালে তার কি মনে হতে বোনের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে রাজের অ্যাকাউন্ট চেক করতে গিয়ে রাজের ভাইয়ের , রাজ কে ট্যাগ করা একটা ফটো দেখে তার পৃথিবী দুলে উঠলো ।আজ রাজের গায়ে হলুদের ফটো কিছুক্ষণ আগে পোস্ট করা হয়েছে। রাজ তার বোনেদের থেকে হলুদ মাখছে হাসি হাসি মুখে । তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কত খুশী ও। ও আর কিছু ভাবতে পারলোনা । লগ-আউট করে ফোনটা রেখেদিল । তার সমস্ত শরীরে কাঁপুনি দিয় জ্বর আসল, সমস্ত হুঁশ লোপ পেল জ্বরের চোটে । তারপর তাকে আবারও হাসপাতালে ভর্তি করাহল। দুদিন পর যখন মিলির হুঁশ ফিরল, তখন সে যেন এক অন্য মানুষ। এ মিলিকে যেন তার কাছের মানুষদের কাছে অচেনা লাগলো । আগের মতো সদা হাসি মুখে থাকা মেয়েটি যেন কোথায় হারিয়ে গেল । সে আবারও হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে এলো । এতো দিনে রাজের বিয়ে বউভাত মিটে গেছে । কিন্তু মিলির সভাব কেমন যেন পাল্টে গেল । সে কারোর সাথে ভালোকরে কথা বলেনা, সারাদিন চুপচাপ থাকে , একটার বেশি দুটো কথা বললে রেগে যায়, ঠিক মতো খায়না, চোখের তলায় দিনে দিনে কালি পড়তে লাগলো । তার বাড়ির লোকেরা ভাবলো অসুস্থ বলে সে এমনটা হয়ে গেছে । একমাত্র আসল ঘটনাটা কি সেটা জানতো অন, এরকম ভাবে মাস খানেক যাওয়ার পর তারকাছে একটা নতুন ছেলের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। ফেসবুকের ছেলেটা যেন তার সাথে যেচে যেচে কথা বলতে লাগলো। মিলির কেমন সন্দেহ হওয়ায় সে রাজের ফোন নাম্বার দিয়ে চেক করে দেখল অ্যাকাউন্টটা রাজেরই। এরপর মিলির আর মাথা ঠিক কাজ করছিল না। সে রাজ কে সরাসরি জিজ্ঞাসা করলো । সে কি চায়? কেন তাকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছে? রাজের উত্তর শুনে সে হতভম্ব হয়ে গেল।
রাজ বলল, দেখ মিলি তুমি আমাকে ব্লক কেন করেছ ? আমি তো দুদিনের জন্যে ব্লক করেছিলাম, যাতে আমার বিয়ের সময় কোন ঝামেলা না হয় । তাই বলে তুমিও আমাকে ব্লক করবে । আমি জানি, আমি তোমাকে তোমার অসুখের সময় দিতে পারেনি । তা বলে তুমি এভাবে রাগ করবে? মিলি আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বলল, আমার আর তোমার সাথে কোন সম্পর্ক নেই । তুমি একজন বিবাহিত পুরুষ অন্য মহিলা কে এভাবে ডিস্টার্ব না করাই তোমার পক্ষে ভাল হবে ।
রাজ বলল আমি বিয়ে করেছি তো কি হয়েছে? তা বলে কি তোমাকে ভালোবাসি না? দেখ বউ থাকবে বাড়িতে, আর তুমি থাকবে কলকাতাতে, আগে যেমন ছিলে আমার তেমনই থাকবে । আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি মিলি। এতোদিন মিলি ভেবেছিল ও যদি অন্য কাউকে নিয়ে সুখী হয় তো হক। কিন্তু আজ ওর কথা শুনে, ঘেন্নায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছা করলো তার । এতোদিন এইরকম একটা নোংরা, বিক্রিতমনষ্ক ছেলেকে সে ভালবেসেছিল? ভাবলেই তার ঘেন্না হচ্ছে নিজের প্রতি ।
এরপর কেটে গেছে একটা বছর । মিলি এখন অনেকটাই সুস্থ্য । সেদিনের পর থেকে সে আর কোন ভাবেই সেই নোংরা ছেলেটার সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখেনি । কিন্তু তার ভাঙা মন আর জোড়া লাগেনি । বরং তাকে আরও পাথরের মতো শক্ত করেছে। এই এক বছরে সে অনেক খেটেখুটে রেলের জুনিয়র ইনজিনিয়ারের চাকরি পেয়েছে । দুদিন পর তার জয়েনিং দেরাদুনে । তাইসে আজ দেরাদুনের পথে চলেছে এক নতুন জীবনের স্বপ্ন দুচোখে মেখে । ট্রেন ছুটে চলেছে দু্র্বার গতিতে । হঠাৎ এক ঝাকুনিতে মিলির ভাবনায় ছেদ পড়ে । না সে আর পিছনে ফিরে তাকাবে না । সে এগিয়ে যাবে নতুন জীবনের পথে। নিজেতো এগিয়ে যাবেই । আর যেসব মেয়েরা অসহায়, যাদের দেখার কেউ নেই, তাদেরকেও সাহায্য করবে সে। তার ইনকামের পয়সা দিয়ে একটা এনজিও খুলবে । সে নিজের কাছে নিজেই শপথ নিল। রাতের শেষে অন্ধকার কেটে গিয়ে, নতুন ভোরের সূর্যের আলো উঠলো এক নতুন দিনের আশার আলো নিয়ে ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন