স্মৃতির আঙিনায়
স্মৃতির আঙিনায়
আজ তিথির মনটা একদম ভাল নেই। আজকাল প্রায়ই মনটা খারাপ হয়ে যায়, কেন যে এমনটা হয় ? তার কোন উত্তর সে খুঁজে পায়না । জীবনের কটা উত্তরই বা খুঁজে পেয়েছে সে? না ! এখন আর সেসব নিয়ে ভাবে না। কেন জানি না, একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা হতেই বেরিয়ে আসে । কথাগুলো ভাবতে ভাবতে আনমনে কখন যে জানালার পাশে এসে বসলো, খেয়ালই করেনি। ছুটির দিনগুলোতে এই ভাড়াবাড়ির জানালা দিয়ে একটুকরো আকাশ দেখতে বড়ো ভালোলাগে তার। এভাবেই সারাটাদিন কেটে যায়। দূরের আকাশ, গ্রীষ্মের দুপুরের নিস্তব্ধতা যেন চারপাশটাকে আরও মোহময় করে তোলে । আর এইরকম গ্রীষ্মের নিস্তব্ধতাময় দুপুরের রোদের তেজ যত বাড়তে থাকে, চারদিকে যেন এক বিরাট শূন্যতা গ্রাস করে । এক এক সময় যেন মনে হয়, কোন অসীম শূন্যতা বিরাজ করছে তার চারপাশে, কোথাও কেউ নেই । সেই সবসময় বড়ো একা মনে হয় নিজেকে। বড়ো ফাঁকা ফাঁকা লাগে, একরাশ নিঃসঙ্গতা ঘিরে ধরে তাকে। তবুও সে চাতকের মতোই বসে থাকে এক টুকরো আকাশ, দূরের ঐ মনখারাপি দুপুরের নিস্তব্ধতা দেখার জন্য । তার বড়ই ভাল লাগে এই মনখারাপি দুপুরের নিঃসঙ্গতা কে উপভোগ করতে । নিঃসঙ্গতা কেও যে উপভোগ করা যায়, তা হয়ত সে জানতোই না যদি চাকরি সূত্রে কলকাতার এই ভাড়াবাড়িতে না আসত । তাও দেখতে দেখতে পঁচিশটা বছর পেরিয়ে গেল। এইতো সেদিন কথা, ও কলেজে পড়ত। তখন দিনগুলো সব কেমন রঙিন ছিল । কত স্বপ্নরা দুচোখের সামনে ডানা মেলে উড়ে বেড়াত। তার খবর আর আজ কেউ রাখেনি। সময়ের সাথে সাথে সব কেমন হারিয়ে যায়; কঠিন, রূঢ় বাস্তবের সামনে। শুধু পড়ে থাকে কর্তব্যের বোঝা। আর যখন তোমার কর্তব্য শেষ, তখন কোন মূল্য নেই তোমার। এই সমাজ,সংসার বড়ই স্বার্থপর। প্রয়োজন শেষে কেও ফিরেও তাকায় না! জীবনটা বড়ই বিচিত্র একটা জিনিস । যতোক্ষ প্রয়োজন ততোক্ষণ পর্যন্ত তোমার মূল্য আছে সবায়ের কাছে। আর যেই প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় সেই তুমি হয়েগেলে মূল্যহীন। আজ যেমন সে হয়ে গেছে ! তাই কেউ আর তাকে মনেও রাখেনি।
হঠাৎ খুব জোরে চীৎকারের আওয়াজে তার ভাবনার সুত ছিড়ে গেল। জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখল, রাস্তা দিয়ে চারজন কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ে কোন বিষয় নিয়ে খুব জোরে জোরে উত্তেজিত ভাবে গল্প করতে করতে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে খিলখিল করে প্রাণখোলা হাসিতে ফেটে পড়ছে।তাদের প্রাণোচ্ছল হাসি দেখে তার স্কুল কলেজের দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়তে লাগলো।ছোট বেলা থেকেই অভাবের সংসারে মানুষ হয়েছে সে। মা-বাবা, আর দুটো ছোট ছোট ভাইবোনকে নিয়ে তাদের ছোট্টো সংসার। বাবা একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে খুব অল্প মাইনেতে চাকরি করতেন, তাতে কোনো রকমে সংসারটা টেনেটুনে চলত। তারওপর ছিল তাদের তিন ভাইবোনের পড়াশুনার খরচ। তাই সংসারে ছিল চরম অভাব, মাসের শেষে কখনো কখনো আধপেটা,খুঁদভাত খেয়েও কাটিয়েছে। পুজোর সময় যখন সব ওর বয়সী বাচ্চারা নতুন জামা কাপড় পড়ে ঠাকুর দেখতে যেত; তখন সে হাসি মুখে পুরোনো রঙচটা জামা পড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে । কোনদিন নতুন জামাকাপড় বা কোন খেলনার কি কোন খাবারের জন্যে বায়না কখনো করেনি। কিন্তু তার ভাইবোনেরা সব কিছুই পেয়ে এসেছে, যতোই সংসারে অভাব থাকনা কেন। তাই বলে সে কখনো অভিযোগ করেনি। বরং খুশীই হয়েছে এটা ভেবে ও যেটা পায়নি ভাইবোনেরা তো পেয়েছে। এটাইবা কম কিসে? ভাল ছাত্রী হওয়া সত্ত্বেও কোনদিন একটা টিউশনি পর্যন্ত নিতে পারেনি। তখনকার সময়ে মাধ্যমিকে ফাস্ট ডিভিশন পেয়েও নিজের প্রিয় সাব্জেক্ট সায়েন্স নিয়ে পড়তে পারেনি পয়সার অভাবে। শুধুমাত্র বাবা মায়ের আর্থিক অবস্থার কথা চিন্তা করে আর্টসে ভর্তি হয়ে গেছিল আর নিজের পড়াশুনার খরচ চালানোর জন্য কিছু বাচ্চাকে পড়াতেও শুরু করেছিল। মনের মধ্যে ছিল নিজের পায়েদাঁড়ানোর এক অদম্য ইচ্ছা। সেযে বাবা মায়ের বড়ো মেয়ে, তাকে যে ওদের পাসে দাঁড়াতে হবে। এতো কিছুর মধ্যেও ওর ছিল এক চঞ্চল,প্রনবন্ত মন। যে রঙিন পাখা মেলে উড়ে বেড়াত স্বপ্নের দুনিয়ায়।
একরকম বেশ ভালোই চলছিল, কিন্তু হঠাৎ করে ওদের জীবনে নেমে এলো এক অশনি-সংকেত । তখন ওর সেকেন্ড ইয়ার পরিক্ষার একমাস বাকি। হঠাৎ একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বাবা স্টোক হয়ে মারা গেলেন। ওদের জীবনে এক লহমায় ছন্দপতন ঘটলো। একদিকে বাবার মৃত্যুশোক, তারওপর কিভাবে তাদের সংসার চলবে সেই চিন্তায় মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এরপর তারা কি খাবে, কি পরবে আর ভাইবোনদের পড়াশুনাও বা কি করে চালাবে? বাবার অফিস থেকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের যতসামান্য টাকা তাদের হাতে দিয়ে অফিস কর্তৃপক্ষ তাদের দায় থেকে মুক্তি পেল। তাদের পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন হাহুতাশ করলো, তারা সবাই কত বিপদে পাশে আছে সেকথা বোঝাল। তিথির পড়া বন্ধ হয়ে গেল। তখন সে হন্যে হয়ে যেকোন একটা কাজের চেষ্টা করছে ।পাড়া-প্রতিবেশী,আত্মীয়স্বজনের দোরে দোরে ঘুরছে একটা চাকরির আশায়। কিন্তু এতোদিন যারা পাশে থাকার কথা বলেছে, তারা সুযোগ বুঝে সরে পড়ল। আগেই আত্মীয়স্বজনরা আর্থিক অবস্থা খারাপ বলে দূরত্ব বজায় রেখেছিল ওদের সাথে, এবারে একেবারেই সম্পর্ক রাখা বন্ধ করে দিল। সবাই একে একে দূরে সরে গেল, একদল সুবিধাভোগী লোক তখন আজেবাজে কথা বলে তাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতেও ছাড়ল না। বাবার অফিস থেকে যেকটি টাকা পেয়েছিল তা শেষ হলে গেল। এদিকে অভাবের তাড়নায় সংসার আর চলে না।তবুও সে কোন অসৎ মানুষের কাছে হার মানেনি।
তখন রোজ রাস্তায় রাস্তায় কাগজে বিঞ্জাপণ দেখে ঘুরে বেড়িয়েছে একটা কাজের চেষ্টায়। এমনই একদিন রাস্তায় দেখা হয়ে যায় তার কলেজের এক সিনিয়র দিদির সঙ্গে। সেই দিদি সব শুনে বলল, দেখ আমি একটা কল-সেন্টার কাজ করি।
তুই কাজ খুঁজছিস, যদি কল-সেন্টারে কাজ করতে চাস তো বল? আমি অফিসে তোর জন্য কথা বলব। লোকে কিন্তু এখানে কাজ করলে ভাল চোখে দেখে না,আবার অনেকে খারাপ মন্তব্যও করতে পারে। কিন্তু বিশ্বাস কর কাজটা খারাপ নয়, এই সব অফিসে অনেক ছেলেমেয়ে কাজ করে একসাথে বসে।
আমি কাজটা পেলে, বেঁচে যাবেগো আমার পরিবারটা। মলিদি, তুমি আমার জন্যে প্লিজ কথা বলো তোমাদের অফিসে।
ঠিক আছে। আমার অফিসের ঠিকানাটা দিচ্ছি । কাল সকাল দশটায় চলে যাস। ইন্টারভিউটা দিয়ে দিস। আর আমি আজ তোর জন্যে কথা বলে রাখছি। পরের দিন ইন্টারভিউ দেওয়ার পর চাকরিটা হয়ে গেছিল তার। সে যেন হাতে স্বর্গ পেল।
শুরু হল তিথির জীবনের নতুন অধ্যায়। রোজ ভোরে অন্ধকার থাকতে থাকতেই অফিসের বাসে করে কাজে যাওয়া, আবার সন্ধ্যের সময় বাড়ি ফেরা। পরের দিন ভোরে আবার বেরোনো। সপ্তাহে একটা ছুটির দিনে কলেজ যাওয়া। এভাবেই কোনরকমে গ্রাজুয়েশনটা কমপ্লিট করল। ছোট ছোট ভাইবোনদের সব পড়াশুনার দ্বায়িত্ব নিল, সংসারের সমস্ত ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল সে হাসি মুখে। কখনো বাবার অবর্তমানে ভাইবোনদের বুঝতেই দেয়নি সংসারের আর্থিক অনটন। তাদের প্রয়োজন সবসময় মিটিয়ে এসেছে। নিজের শখ আহ্লাদের দিকে কোন দিন ফিরেও তাকায়নি। যৌবনকালে তার দু-একটা বিয়েরও সম্বন্ধ এসেছিল। কিন্তু মা আর ভাইবোনদের কথা ভেবে সে বিয়ে করতে রাজি হয়নি,বিয়ে করে চলেগেলে মা আর ভাইবোনকে কে দেখত?
ততদিনে সে তার কল-সেন্টারের কাজ ছেড়ে একটা বিদেশী কোম্পানীর ব্যাক অফিসে একটু বেশি টাকা মাইনের চাকরিও পেয়েছে । দেখতে দেখতে ভাইও ইনজিনিয়ারিং পাশ করে চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে গেল আর সেখানেই একটা প্রবাসী মেয়েকে বিয়ে করে সেটেলড হয়ে গেল। তাদের সাথে আর কোন সম্পর্ক রাখলো না। বোনও কলেজে পড়তে পড়তে একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম করল। তারপর বিয়ে করে ব্যাঙ্গালোর চলে গেল।
পড়ে রইলো ও আর মা। এরপর ভাইবোনরা মা-দিদির আর খোঁজ রাখেনি । তিথি যখন ভালোবাসার তাগিদে তাদেরকে ফোন করত, তারা বিরক্ত হত, দুচার কথা শুনিয়েও দিত তাকে।
এরপর মাও একদিন তাকে একা ফেলে রেখে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন । সেও প্রায় তিন বছর হয়ে গেল ।তিথি বুঝে গেছিল ওর ছোট্টো দুটো ভাইবোনের কাছে আজ সে অবাঞ্ছিত একটা মানুষ। তাই আর কখনো ওদেরকে বিরক্ত করেনি। ওরা ওদের মতো করে ভাল থাকুক , সুখে থাকুক । যত আঁধার নাহয় তার জীবনেই থাক। আকাশটা সায়াহ্নের কালো আঁধারে ঢেকে গেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিঃশব্দে বেরিয়েএল সেই আঁধারের বুকচিরে ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন