রায়বাঘিনী রানী ভবশঙ্করী
পশ্চিমবঙ্গের অনেক মানুষের কাছে ভবশঙ্করী নামটা খুব একটা পরিচিত নয় । কিন্তু এই ভুরীশ্রেষ্ঠ রানী ছিলেন একজন বীরাঙ্গনা মহিলা ।
রানী ভবশঙ্করী জন্মসূত্রে ছিলেন ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের দুর্গরক্ষক দীননাথ চৌধুরীর কন্যা । এই ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য বর্তমানে হাওড়া হুগলি জেলার অন্তর্গত । ছোট বেলাতেই ভবশঙ্করী পিতার কাছে অস্ত্র শিক্ষা পান এবং পরবর্তীকালে ভুরীশ্রেষ্ঠের পন্ডিতদের কাছ থেকে রাজনীতি, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র, সমাজতন্ত্র প্রভৃতি সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেছিলেন ।
এরপর স্বাধীনচেতা, যোদ্ধা ভবশঙ্করীর মায়ের মৃত্যুর পরে তার পিতা তাকে ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের রাজা রুদ্রনারায়নের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দেন । তারপরেই ভবশঙ্করী পরিচিত হন রানী ভবশঙ্করী নামে । তিনি ছিলেন দেবী চন্ডীর ভক্ত । সেই জন্য বিবাহের পরেই তিনি রাজপ্রাসাদের পাশে দেবী চন্ডীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি রোজই ভক্তি সহকারে দেবী চন্ডীরথ পূজা করতেন । সেই কারনে আজও হাওড়া এবং হুগলি জেলায় বেতাই চন্ডী ও মেলাই চন্ডীর পূজা হয়ে থাকে ।
এছাড়াও রানী ভবশঙ্করী ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের সুরক্ষা ব্যবস্থার দিকে দিকে বিশেষ ভাবে নজর দেন । তিনি ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অনেকগুলি সামরিক দুর্গ নির্মান করান । তিনি তমলুক, খানাকুল, ছাউনপুর, আমতা, উলুবেড়িয়া, নস্করডাঙ্গায় দুর্গ নির্মান করান । সাম্রাজ্যের সামরিক প্রশিক্ষণের বিশষটিকে তিনি দেখভাল করতেন এবং তিনিই প্রথম ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের মহিলাদরকে সেনাবাহিনীতে উপযুক্ত যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিয়ে সেনাবিহিনীর অন্তর্ভুক্ত করেন । এরপর তিনি প্রতিটি পরিবার থেকে একজনকে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখেন যাতে আপৎকালীন পরিস্থিতিতেও যুদ্ধক্ষেত্রে সেনার অভাব না দেখা দেয় । রানী ভবশঙ্করীর কর্মদক্ষতায় ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য হাওড়া এবং হুগলি ছাড়িয়ে পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং পূর্ব মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ অংশে ছড়িয়ে পড়ে । তাঁর আমলে সাম্রাজ্যের নৌ-বাহিনী ও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠে ।
সেই সময় গৌড়ের শাসক ছিলেন পাঠান বংশের সুলেমান কারী । এই পাঠান শাসকরা অতর্কিত হামলা করে ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে লুটপাট চালাত । এই পাঠানদের আক্রমন রুখতে রানী ভবশঙ্করীর পরামর্শে রাজা রুদ্রনারায়ন উড়িষ্যার রাজা মুকুন্দদেবের সাথে জোট করেন । ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ ত্রিবেণীর যুদ্ধে এই যৌথ সেনাবাহিনীর কাছে সুলেমান কারী পরাজিত নিহত হন ।
এরপর সুলেমানের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দাউদ খান গৌড়ের শাসক হন এবং তিনি মুঘলদের পরাজিত করার জন্য রাজা রুদ্রনারায়নের সাহায্য চান । রুদ্রনারায়ন রাজি না হওয়ায় দাউদ খান তাঁর সেনাপতি কলটু খানকে ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য আক্রমন করার নির্দেশ দেন । রুদ্রনারায়নের সেনাবাহিনীর কলটু খানকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত এবং হত্যা করে । এই যুদ্ধে একটি বিশাল অংকের পাঠান সেনার মৃত্যু হয় । এরফলে ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের একটি বৃহৎ অংশ পাঠান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার থেকে রক্ষা পায় ।
এর কিছুদিন পরে, রানী ভবশঙ্করী পুত্র প্রতাপনারায়নের জন্ম দেন । প্রতাপনারায়নের বয়স যখন ৫ বছর তখন রাজা রুদ্রনারায়নের মৃত্যু হয় ।
রাজা রুদ্রনারায়নের মৃত্যুশোকে রানী ভবশঙ্করী রুদ্রনারায়নের চিতায় নিজেকে আহুতি দিতে চাইলে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ বংশের কুল পুরোহিত তাঁকে বাধা দেন এবং রাজপুত নাবালক থাকায় ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যের দ্বায়িত্ব গ্রহন করতে অনুরোধ করেন । কিন্তু সেই মুহূর্তে রানী ভবশঙ্করী সম্পূর্ণ ভাবে রাজ্যের শাসনকার্য করার জন্যে মানুষিক ভাবে তৈরী ছিলেন না । তাই তিনি নিজেকে মানুষিক ভাবে
প্রস্তুত করার জন্য তিনমাস সময় চেয়ে নেন । ততদিন পর্যন্ত তিনি রাজ্যের দ্বায়িত্ব সেনাপতি চতুর্ভূজ চক্রবর্তী ও রাজস্ব মন্ত্রী দুর্লভ দত্তের উপর দেন এবং নিজে কাস্তাসনগড়ে মহাদেবের মন্দিরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন নিজ পুত্র এবং পাঠান আক্রমনের কথা মাথায় রেখে খুবই বিশ্বস্ত এবং শক্তিশালী মহিলাদের একটি সেনাদলকে নিয়ে ।
কিন্তু তাঁর অবর্তমানে সেনাপতি চতুর্ভূজ চক্রবর্তী রাজ্যের ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে সুলতান ওসমান খানের সঙ্গে চক্রান্ত করেন রানী ভবশঙ্করী এবং তাঁর নাবালক পুত্রকে হত্যা করার । সেইমতো চতুর্ভূজ সমস্ত তথ্য ওসমান খানের কাছে পৌঁছে দেন এবং ওসমান খান তাঁর সেনাবাহিনীর বাছাই করা সেনা নিয়ে ভবশঙ্করীকে হত্যার উদ্দেশ্যে হিন্দু সন্যাসীর তিনি ছদ্মবেশে ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যে প্রবেশ করেন । এছাড়াও বহু পাঠান সৈন্য ব্যবসায়ী , পর্যটক, ফকির ইত্যদি ছদ্মবেশে ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যে প্রবেশ করেন । কিন্তু বর্তমানে হাওড়ার অন্তর্ভুক্ত আমতার দুর্গে থাকা সেনা ইউনাইটেড সেনারা আগে থেকেই রানী ভবশঙ্করীকে পাঠান আক্রমনের খবর পাঠান । রানী ভবশঙ্করী খবর পাওয়ার সাথে সাথে আসেপাশের দুর্গগুলি থেকে দক্ষ সেনাদের ডেকে পাঠান এবং তাদেরকে আসেপাশের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে নির্দেশ দেন । তিনি নিজের সাথে বিশ্বস্ত নারীসেনাসহ যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে পূজোয় বসেন এবং নিজের শরীরে সাদা কাপড় জড়িয়ে নেন । গভীর রাতে পাঠান সৈন্য আক্রমন করলে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং বহু সংখ্যক পাঠান সৈন্যরা পরাজিত এবং নিহত হন।
এই যুদ্ধে ওসমান খান পালিয়ে যান এবং রানীর কাছে গোয়েন্দা মারফৎ খবর পৌঁছায় চতুর্ভূজের চক্রান্তের কথা কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে তাকে শাস্তি দিতে পারেনি । কিন্তু এরপর রাজ্যের শাসনকার্য নিজের কাঁধে তুলে নেন রানী ভবশঙ্করী ।
দ্বায়িত্ব গ্রহন করেই চতুর্ভূজ চক্রবর্তীকে তিনি সেনাপতি পদ থেকে সরিয়ে তার জায়গায় ভূপতি কৃষ্ণ রায়কে সেনাপতি নিযুত করেন এবং রাজ্যের সেনা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সংখ্যা আরো বাড়িয়ে দেন। এরপরেই রানী ভবশঙ্করীর পাঠান আক্রমনের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াইয়ের খবর দিকে দিকে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে ।
এর কিছুদিন পরে রানী ভবশঙ্করীর রাজ্যাভিষেক হয় তান্ত্রিক মতে ছাউনপুরের অন্তর্গত বাঁশুড়ি গ্রামের ভবানী মন্দিরে ।
পদচ্যুত সেনাপতি চতুর্ভূজ আবারো চক্রান্ত করতে থাকে রানী ভবশঙ্করীকে হত্যা করে ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য দখলের । এই উদ্দেশ্যে তিনি ওসমান খানের সঙ্গে হাত মেলান এবং এবার প্রতিশ্রুতি দেন নিজের বিশ্বস্ত সেনাদের নিয়ে ভুরীশ্রেষ্ঠ রাজ্য আক্রমন করবেন । সেইমতো ওসমান খান সেনাবাহিনীর নিয়ে খানাকুল জঙ্গলে লুকিয়ে থাকেন , সেই খবর এক শিকারী খানাকুল দুর্গে পৌঁছে দেন কিন্তু সেখানে চতুর্ভূজ থাকায় তিনি তা গুজব বলে উড়িয়ে দেয় । ( ভূপতি কৃষ্ণ রায় তখন বিশেষ কাজে বাইরে থাকায় চতুর্ভূজ দুর্গের দায়িত্বে ছিলেন ।)
কিন্তু রানীর গুপ্তচর মারফৎ সে খবর রানী ভবশঙ্করীর কাছে পৌঁছে যায় । তিনি জানতে পারেন তাঁর রাজ্যাভিষেক দিন পাঠান আক্রমন করতে চলেছে । তিনি তৎক্ষণাৎ তার ব্যবস্থা নেন । ভূপতি কৃষ্ণকে ডেকে পাঠান এবং বিভিন্ন দুর্গ থেকে সেনাদের নিজের কাছে ডেকে নেন এছাড়াও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সমস্ত সেনাদের তৈরী থাকতে নির্দেশ দেন ।
ওসমান খানের নেতৃত্বে পাঠান সৈন্য এবং চতুর্ভূজ চক্রবর্তীর সঙ্গে থাকা সেনা একসাথে বাশুড়িতে আক্রমন করে। কিন্তু রানী ভবশঙ্করী আগে থেকেই তৈরী ছিলেন । দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয় এবং রানী ভবশঙ্করীর নেতৃত্বে আবারো ভুরীশ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্য যুদ্ধে জয়লাভ করে । ওসমান খান পরাজিত হয়ে উড়িষ্যায় পালিয়ে গিয়ে নিজের প্রাণ বাঁচান । যুদ্ধের পর রানীর রাজ্যাভিষেক হয় ।বীরাঙ্গনা রানী ভবশঙ্করীর বীরত্বের কথা মোঘল সম্রাট আকবরের কাছে পৌঁছায় এবং তিনি রানী ভবশঙ্করীকে "রায়বাঘিনী" উপাধীতে ভূষিত করেন ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন